স্প্যানিশ ফ্লুর মারণ প্রকোপ ও আজিকার করোণা ভাইরাস
![]() |
সম্পাদকীয়: দ: আফ্রিকা হইতে প্রত্যাগত গান্ধীজী অচিরেই সবরমতি আশ্রম স্থাপনা করেন এবং সাত্ত্বিক জীবন ও আচারে রত হন। ইতিমধ্যে তিনি গবাদি পশুদিগের দুগ্ধোৎপাদন বর্ধন হেতু নিষ্ঠুর 'ফুকা' প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন ও গোদুগ্ধ সেবন পরিত্যাগ করেন। ইহাই সেই বিষাদময় সময় যখন সমগ্র বিশ্বে তথা ভারতবর্ষে 'স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা'-র প্রকোপ মহামারীর আকার লইয়াছে। বাপুও 'ফ্লু ' হইতে নিস্তার পান নাই, ও তাঁহার দেহ ভগ্নপ্রায় হয়। বৈদ্য গান্ধীজীকে স্বাস্থ্যার্থে দুগ্ধসেবন পুনরায় আরম্ভ করিতে উপদেশ দেওয়ায়, তিনি গোদুগ্ধের পতিবর্তে ছাগদুগ্ধ পান করিতে লাগিলেন। গান্ধীজীর নিজ শরীর প্রতি এহেন অবহেলায় ক্ষুন্ন হইয়া 'প্রজা বন্ধু' নামক এক পত্রিকা লিখিল, 'গান্ধীজীর প্রাণ তাঁহার নিজ সম্পত্তি নহে, সমগ্র ভারত দেশের সম্পত্তি।'
ইহা অনুমান যে ১৯১৮-১৯ সনে 'স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা' বিশ্ব জুড়িয়া এক তৃতীয়াংশ জনসংখ্যার মরণের কারক হইয়াছিল। ভারতে এহি জ্বর এক মন্বন্তর রূপী মড়ক হইয়া আবির্ভূত হয়। ইংরাজ লাটের গোরা সরকার কালা দেশীয়দিগের রোগ উপশমের কোনও চেষ্টাই করে নাই। ফলস্বরূপ দিন দিন নগর হইতে নগর, গ্রাম হইতে গ্রাম, এহি সংক্রামক ব্যাধির কবলে পড়িয়া ধরাশায়ী হয়। মৃত্যুই ভবিতব্য ভাবিয়া নগরবাসী মানুষ চিকিৎসার কিঞ্চিৎ সাধন যাহা অবশিষ্ট ছিল তাহাও লাভ করে নাই; উপনগর বা গ্রামাঞ্চলে নিষ্কৃতির লেশমাত্র উপলব্ধ ছিল না। গৃহাবদ্ধ হইবা সত্ত্বেও পুরুষ হইতে নারীদের উপরে এই দুরারোগ্য ব্যাধির প্রকোপ অধিক মাত্রায় হইয়াছিল, নথি মাধ্যমে ইহাই জ্ঞান হয়।
সমকালীন বঙ্গজাত লোকপ্রিয় হিন্দি কবি সূর্যকান্ত ত্রিপাঠি যিনি 'নিরালা' নামেই অধিক প্রসিদ্ধ, তাঁহার আত্মজীবনীতে লিখিলেন, 'সসুরাল জানে পর মালুম হুয়া, স্ত্রী গুজর চুকী হ্যাঁয়; দাদাজাদ বড়ে ভাই সাহিব কি লাশ যা রহি হ্যাঁয়। রাস্তে মেঁ চক্কর আ গয়া। সর পকড়কর বৈঠ গয়া। ঘর জানে পর ভাবী বিমার পড়ি। পুছা, 'তুমহারে দাদা কো কিতনি দূর লে গয়ে হোঙ্গে?' ম্যাঁয় চুপ হো গয়া। উনকে চার লড়কে অউর এক দুধ পীতি লড়কি থি। ... ভাই সাহিব কী নিকলনে কে সাথ সাথ চাচাজী ভী বিমার পড়ে। মুঝে দেখকর কহা, 'তু য়হাঁ কিউঁ আয়া?' স্ত্রী অউর দাদা কে বিয়োগ কে বাদ হৃদয় পত্থর হো গয়া। ম্যাঁয়নে কহা, 'আপ অচ্ছে হো যায়েঁ তো সবকো লেকর বঙ্গাল চলুঁ।'...দাদা কে গুজরনে কি তিসরে দিন ভাবী গুজরি। উনকী দুধ পীতি লড়কি বিমার থি। রাত কো উসে সাথ লেকর সোয়া। বিল্লি রাত ভর অফৎ কিয়ে রহী। সুবহ উসকে ভী প্রাণ নিকল গয়ে।'
মৃত্যুর এমত বিভীষিকার ইতিহাস বোধ করি ইহা হইতে অধিক মর্মভেদী হইতে পারিত না। বিদ্যালয়গুলিকে অস্থায়ী চিকিৎসাগার করিয়া বহু দেশীয় প্রতিষ্ঠান সেবা করিয়া গিয়াছে। ইহাদের মধ্যে অধিকাংশই স্বাধীনতাকামী সংগঠনগুলি ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও 'স্প্যানিশ জ্বর'-এর এহেন যুগল কশাঘাত ভারত তথা বঙ্গ জীবনে হাহাকার ব্যতীত, কেবল পুনরোদয় ঘটাইয়াছিল দেশাত্মবোধের।
'একাধারে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের হত্যালীলা চলিতেছে; ভারতের তাবল্লুন্ঠিত আর্থিনীতি উপর্যুপরি ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে, কর্মালয়ে হোতা নাহি, ব্যবসা-বিপনীতে ক্রেতা নাহি, ব্যাধিগ্রস্তের ত্রাতা নাহি; অপর দিকে 'স্প্যানিশ জ্বর' বহিয়া আনিয়াছে মৃত্যু। আবালবৃদ্ধবনিতা লক্ষ লক্ষ মানুষ বিনারোগ্যে প্রিয়জন খুইয়া ক্রন্দন করিতেছে - ক্ষুধার প্রহার, দারিদ্র্যের ভর্ৎসনা, মড়কের তাড়না - ত্রিবিধ বিড়ম্বনায় বিপর্যস্ত বহু মানুষ মৃত্যু না অসিলেও উহাকেই শ্রেয় বলিয়া কামনা করিয়াছে।
পরাধীন দেশে 'স্প্যানিশ ফ্লু'-র আর্তসংখ্যা কোটি অতিক্রম করিয়াছিল। আজিকার করোণা ভাইরাস আশা করি স্বাধীন ও সমর্থ ভারতে 'স্প্যানিশ ফ্লু'-তুল্য হন্তা হইয়া উঠিবে না, তথাপি এহি জনবহুল রাষ্ট্রে অতিসাবধান না হইলেই নহে। ইহার বাস্তব শিক্ষা আমরা পাইয়াছি ২০০৯ অব্দের 'সোয়াইন ফ্লু'-র প্রকোপে, যাহার কবলে পড়িয়াছিল ভারতের ১৩,০০০-এরও অধিক মানুষ, ও মরণ হইয়াছিল চতুর্শতোত্তর নাগরিকের। অতএব, করোণাকে পরাজিত করিতে হইলে শৈথিল্যের কিঞ্চিৎ মাত্র কণা পোষণ করিলে চলিবে না। 'সামাজিক দূরত্ব' পালন করিবার বিধি ভূত কালে গোরা সাহেবের অনুচরগণ 'নেটিভ' দেশবাসীদিগে শিখায় নাই, কিন্তু অদ্য স্বাধীন দেশের সরকার করোণার প্রসার রোধকল্পে বহুমুখী পদক্ষেপ লইয়াছে। ইহাই আমাদিগের সৌভাগ্য। বিধির পালন এক্ষণে সামাজিক ধর্মের স্থান পাইয়াছে। ইহাকেই মহামারী কালীন ধর্ম বলিয়া আচরণ করাই হইবে সমাজের একমাত্র কর্তব্য।
সর্বে অপি সুখিন: সন্তু। সর্বে সন্তু নিরাময়া:। সর্বে ভদ্রাণি পশ্যন্তু । মা কশ্চিদ্দু:খভাগভবেৎ।
- সম্পাদক
চিত্র সত্ত্ব: কমন্স
Post a Comment